প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া দম ধরে রেখে ইউক্রেন থেকে ফিরে আসতে পারবে তো? নাকি আটকে যাবে আফগানিস্তানে যেমন গিয়েছিল

Date: 2022-07-13
news-banner
ইউক্রেনে রুশ সেনা অভিযানের একটা বাংলা নাম দেওয়া যায়—হাডুডু অভিযান। যেকোনো যুদ্ধই মর্মান্তিক এবং বীভৎস রকম ট্র্যাজিক। তবু বোঝার সুবিধার জন্য হাডুডু খেলার আদলে এই যুদ্ধকে বুঝে দেখা যেতে পারে। হাডুডু খেলায় প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে তাদের খেলোয়াড়দের ছুঁয়ে দিয়ে ফিরে আসাকেই জয় বলে ধরা হয়। প্রতিপক্ষের কোর্ট দখল করা এই খেলার উদ্দেশ্য নয়। যাকে ছুঁয়ে দেওয়া হবে, সে পরাজিত হবে। সে চলে যাবে কোর্টের বাইরে। শুধু ছুঁয়ে দিলেই হলো না; দম ধরে রেখে নিজের কোর্টে ফিরে আসতে পারতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া দম ধরে রেখে ইউক্রেন থেকে ফিরে আসতে পারবে তো? নাকি আটকে যাবে আফগানিস্তানে যেমন গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসনকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধই বলেছিল। তবে রাশিয়া তার আক্রমণকে পুরোপুরি যুদ্ধ বলছে না। পুতিনের ভাষায় এটা হলো ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করা এবং সেখানে ছড়িয়ে পড়া ‘নাৎসিবাদী ভাড়াটে যোদ্ধাদের’ নির্মূল করার ‘স্পেশাল’ অভিযান। অর্থাৎ রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটা তার নিজস্ব সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ, যে সন্ত্রাস চালানো হচ্ছিল ইউক্রেন থেকে আলাদা হওয়া যমজ শিশুরাষ্ট্র এবং ইউক্রেনের রুশভাষীদের বিরুদ্ধে।
 
 
কিন্তু বাস্তবে অভিযানটা আর আত্মরক্ষামূলক নেই। পুরোপুরি যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ইউক্রেনের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা পাওয়া কঠিন। রুশ বয়ানে ভরসা রাখারও কারণ নেই। কিন্তু যেখানে পশ্চিমা দুনিয়া একে তথ্য বিশ্বযুদ্ধে পরিণত করেছে, বিশ্বের সব বড় মিডিয়া যখন এক সুরে কথা বলছে, যখন ফেসবুক নিজের নীতিমালা ভেঙে রাশিয়া ও পুতিনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতার উসকানির অবাধ সুযোগ খুলে দিয়েছে, তখন কোথায় গেল সেইসব ইউরোপীয় মূল্যবোধ?
 
এ অবস্থায় দেশে দেশে দস্যুতা ও আগ্রাসনের জন্য যাঁরা আমেরিকাবিরোধী হয়ে আছেন, তাঁরা রাশিয়ার পক্ষে হেলে পড়ছেন। ইরাক-আফগানিস্তান-সিরিয়া-হাইতি-পানামার ঘটনায় যাঁদের মন আগেভাগেই বিষিয়ে আছে, তাঁদের বিবেক মার্কিন বয়ানে সাড়া দিতে চাইছে না। পাশ্চাত্যের নোয়াম চমস্কি, স্লাভোয় জিজেক, জন মার্শমিয়ারের মতো অধ্যাপকেরা যুদ্ধের নিন্দা করলেও সব দায় একা পুতিনকে দিচ্ছেন না। এই জটিল মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন দার্শনিক হামিদ দাবাশি কিংবা আল-জাজিরার মারওয়ান বিশারার লেখালেখিতে। মারওয়ান বিশারা এককথায় এই মনোভাবকে প্রকাশ করেছেন: ইউক্রেনের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নে বিভক্ত।
 
 
অনেক রাষ্ট্রের জন্য এটা উভসংকট। এই উভয়সংকট থেকে জার্মানি পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পেরেছে, তা বলা যায় না। তেলের দাম ১৩০ ডলারে ওঠার পর জার্মানি, বুলগেরিয়া ও ফ্রান্সসহ আরো কিছু ইউরো-দেশ বলছে রুশ তেল-গ্যাস ছাড়া তারা চলতে পারবে না। ব্রিটেনের মতো করে ফ্রান্সও যুক্তরাষ্ট্রের মোসাহেবগিরি করতে নারাজ। ন্যাটো’র ফাটল চোখে পড়ে যাচ্ছে্।
 
খোলাখুলি পুতিনের পক্ষেও কম দেশই আছে। আমেরিকার চিরবন্ধু মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতাধর দেশগুলো কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পালে এবার আর হাওয়া দিচ্ছে না। তারা এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বহুমুখী করার পথে। ইরান-ভেনেজুয়েলাও তেল বেচছে না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। মওকামতো সৌদি জোটও যদি বেঁকে বসে, তাহলে রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞার দাম অনেক চড়া হয়ে যাবে। সৌদিদের পক্ষে টানতে এর মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সৌদি আরবে ছুটেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে সমৃদ্ধি ইউরোপকে শান্তি দিয়েছে, তাতে টান পড়ছে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চললে অনৈক্য, অসন্তোষ আর অস্থিরতা ইউরোপকে অশান্ত করে তুলতে পারে। পুতিন রয়েসয়ে আক্রমণ করছেন যাতে বেসামরিক নাগরিকেরা সরে যেতে পারে এবং যাতে ৫ থেকে ১০ মিলিয়ন উদ্বাস্তুর চাপে ইউরোপের অর্থনীতি আরও কাবু হয়ে যায়।
পুতিন অবশ্যই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লংঘন করে নৈতিক অপরাধ করেছেন, কিন্তু কৌশলগতভাবে কতটা ভুল করেছেন, তা বলার সময় এখনো আসেনি। শেষ পর্যন্ত এটা দমেরই খেলা। ইউক্রেনীয় ফ্রন্টে কার দম আগে ফুরোবে, পুতিনের সেনাদের নাকি জেলেনস্কির জোড়াতালি প্রতিরোধের? রুশ আক্রমণের মুখে দুই সপ্তাহ টিকে থেকে তিনি যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন।
মহামারি সামলে নাজুক হয়ে পড়া ইউরোপীয় অর্থনীতির পিঠে অর্ধকোটি শরণার্থীর ভার চাপিয়ে দিতে পারলে ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষিতে রাশিয়ার সুবিধা হবে। এটা হবে অর্থনৈতিক অবরোধের প্রতিশোধ। এখন আইএমএফের লোকেরাও বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবরোধের মাশুল ইউরোপকেও ভালোমতোই দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মুদ্রা হিসেবে ডলারের একচেটিয়া অবস্থানও টলে যাবে। ইতিমধ্যে রাশিয়া, চীন, কাজাখস্তান, কিরঘিসস্তান, বেলারুশ, আর্মেনিয়া মার্কিন শাসিত অর্থব্যবস্থার বাইরে স্বাধীন মুদ্রাব্যবস্থা গঠনে একমত হয়েছে। ইরান, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশও এর জন্য অপেক্ষমান। দেশগুলি নিজেদের মধ্যে মুক্তবাজার চালু করবে। সম্ভবত চীনা ইউয়ান হবে তাদের বিনিময় মুদ্রা। এদিকে ভারত মার্কিন হুশিয়ারি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনছে। অবশ্যই এই বিনিময় ডলারে হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধের ফল যাই-ই হোক, ডলারের একচেটিয়া কারবারের দিন শেষ হতে চলেছে। ইউরোপের মাটিতে যুদ্ধের পরিণাম সুদূরপ্রসারী।
 
ন্যাটো ব্লকের বিভক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো ঠিক এখনই কেন তারা দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর হামলে পড়ল? সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। বাইডেন বলে দিয়েছেন, একজন মার্কিন সেনা বা একটি প্লেনও ইউক্রেনে পাঠানো হবে না।

Leave Your Comments